রবিবার ৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ - ১২:০০
ইমাম মাহদী (আ.)

হাওজা / ইমাম মাহদী (আ.)-এর জন্য প্রকৃত অপেক্ষা: হাদীসের আলোকে নির্দেশনা


হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, ইমাম মাহদী (আ.)-এর জন্য প্রকৃত অপেক্ষা: হাদীসের আলোকে নির্দেশনা

রাসূল (স:) বলেছেন:
"أَفْضَلُ الْأَعْمَالِ انْتِظَارُ الْفَرَجِ"
"সর্বোত্তম আমল হলো মুক্তির (ইমাম মাহদী আঃ এর জুহুর) জন্য অপেক্ষা করা।"

 সূত্র:
আল-ইখতিসাস, শায়খ মুফীদ, পৃষ্ঠা ২৮৪
বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৫২, পৃষ্ঠা ১২২
 নুওরুস সাকালাইন, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৬২

ভূমিকা:
ইমাম মাহদী (আ.) জন্মগ্রহণ করেন ১৫ই শাবান, ২৫৫ হিজরি (৮৭০ খ্রিষ্টাব্দ) শুক্রবার রাতে, ইরাকের সামররা শহরে।
ইসলামি বিশ্বে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন, যা আশার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে, শুধুমাত্র জন্মদিন উদযাপন করাই যথেষ্ট নয়; বরং আমাদের উচিত ইমামের (আ.) আগমনের জন্য যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা। কুরআন ও হাদীস অনুযায়ী প্রকৃত "ইন্তেজার" বা অপেক্ষা শুধুমাত্র ইমামের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা নয়, বরং আত্মশুদ্ধি, দ্বীনের পথে অবিচল থাকা এবং ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করাকে অন্তর্ভুক্ত করে।

ইমাম মাহদী (আ.)-এর বংশ পরিচয়:
পূর্ণ নাম: মুহাম্মাদ ইবনে হাসান আল-মাহদী
পিতা: ইমাম হাসান আসকারী (আ.) (১১তম ইমাম)
মাতা: নরগিস খাতুন (একজন ধার্মিক ও জ্ঞানের অধিকারী নারী, যিনি রোমান রাজবংশের বংশধর ছিলেন)
বংশ: আহলুল বায়েত (রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর বংশধর)
কুনিয়া (সম্বোধনীয় নাম): আবুল কাসিম (যেমন রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর কুনিয়া ছিল)

ইমাম মাহদী (আ.)-এর উপাধি:

ইমামের (আ.) বিভিন্ন উপাধি রয়েছে, যা তাঁর বৈশিষ্ট্য ও ভূমিকা নির্দেশ করে। এর মধ্যে প্রধান উপাধিগুলো হলো:

১. আল-মাহদী (المهدي) – যিনি হিদায়াতপ্রাপ্ত এবং অন্যদের সঠিক পথে পরিচালিত করবেন।
২. আল-হুজ্জাহ (الحجة) – যিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবতার জন্য চূড়ান্ত প্রমাণ।
৩. আল-কায়েম (القائم) – যিনি সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য উঠে দাঁড়াবেন।
৪. আল-মুনতাজার (المنتظر) – যিনি অপেক্ষারত, এবং যাঁর আগমন মুসলমানরা অপেক্ষা করছে।
৫. সাহিবুয জামান (صاحب الزمان) – যিনি সময়ের অধিপতি বা সময়ের ইমাম।
৬. বাকিয়্যাতুল্লাহ (بقية الله) – যিনি আল্লাহর অবশিষ্ট প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে আসবেন।

এই নিবন্ধে, আমরা ইমামের (আ.) জন্য অপেক্ষার প্রকৃত অর্থ, তার জন্য আমাদের দায়িত্ব এবং হাদীসের আলোকে কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে তা আলোচনা করবো।

প্রথম অধ্যায়: প্রকৃত অপেক্ষার অর্থ

"ইন্তেজার" শব্দটি আরবি "নাযর" মূল থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো কিছু দেখার জন্য আগ্রহী হয়ে অপেক্ষা করা। হাদীস অনুসারে, প্রকৃত ইন্তেজার কেবল মনোভাবের পরিবর্তন নয়; বরং এটি একটি সক্রিয় জীবনধারা যেখানে ইমামের (আ.) জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়।

১. প্রকৃত ইন্তেজার হলো আমলের মাধ্যমে অপেক্ষা করা

হাদীসে এসেছে:
হজরত মুহাম্মদ (স:) বলেছেন:
"أفضل أعمال أمتي انتظار الفرج"
(আমার উম্মতের সর্বোত্তম আমল হলো মুক্তির জন্য অপেক্ষা করা)।
 (শায়খ সাদুক, কামাল আদ-দীন, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৮৭)

এই হাদীস থেকে বোঝা যায় যে, শুধুমাত্র ইমামের (আ.) প্রতি আবেগপ্রবণ ভালোবাসা যথেষ্ট নয়; বরং আমল ও প্রস্তুতির মাধ্যমে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

দ্বিতীয় অধ্যায়: ইমামের (আ.) জন্য অপেক্ষার পদ্ধতি

১. আত্মশুদ্ধি ও নৈতিক উন্নতি:

আমাদের অপেক্ষা করা উচিত আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে। ইমাম (আ.) ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন, তাই আমাদের নিজেদের ন্যায়পরায়ণ করতে হবে।

ইমাম আলী (আ.) বলেন:
"তোমরা এমন হও যেন তোমরা সেই ইমামের আগমনের জন্য প্রস্তুত থাক, যিনি সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক।"
 (নাহজুল বালাগা, চিঠি ৩১)

২. ইমামের (আ.) পথের অনুসারী হওয়া:

ইমাম (আ.) ইসলামের শুদ্ধতম রূপকে প্রতিষ্ঠা করবেন। অতএব, আমাদের জীবনে ইসলামের মূলনীতি বাস্তবায়ন করতে হবে।

ইমাম বাকির (আ.) বলেন:
"যে ব্যক্তি আমাদের কিয়ামের জন্য অপেক্ষা করে, সে যেন তার জীবনধারায় তাকওয়ার সাথে জীবনযাপন করে।"
 (বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৫২, পৃষ্ঠা ১৪০)

৩. ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম করা:

ইমাম (আ.) বিশ্বে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। তাই আমাদের উচিত সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়া।

ইমাম আলী (আ.) বলেন:
"তুমি জুলুমের বিরুদ্ধে অবস্থান নাও, কারণ যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে নীরব থাকে, তারা তার সহযোগী হয়।"
 (নাহজুল বালাগা, হিকমা ৪৭৩)

ইমাম সাদিক (আ.) বলেন:
"যে ব্যক্তি সত্য ও ন্যায়ের জন্য কাজ করে, সে আমাদের কায়েমের (ইমাম মাহদী) জন্য অপেক্ষা করছে।"
 (বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৫২, পৃষ্ঠা ১২২)

তৃতীয় অধ্যায়: ইমামের (আ.) অনুপস্থিতির সময়ে আমাদের করণীয়

১. দোয়া ও সংযোগ বজায় রাখা:

আমাদের ইমামের (আ.) জন্য দোয়া করতে হবে।

ইমাম মাহদী (আ.) নিজে বলেন:
"আমার জন্য বেশি বেশি দোয়া করো, কারণ দোয়া তোমাদের মুক্তির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।"
 (কামাল আদ - দীন, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪৮৫)

২. একতা ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা:

ইমামের (আ.) রাষ্ট্রব্যবস্থা একতাবদ্ধ মুসলিম উম্মাহর ভিত্তিতে গড়ে উঠবে। তাই আমাদের উচিত নিজেদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করা।

হাদীস:
"আমার উম্মাহ যখন একত্র হবে, তখন আমার কিয়াম (জহুর) দ্রুত হবে।"
 (বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৫২, পৃষ্ঠা ৩২৭)

৩. ইমামের (আ.) প্রতি আনুগত্যের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা:

আমাদের প্রতিজ্ঞা করা উচিত যে, আমরা ইমামের (আ.) আদর্শ থেকে দূরে যাব না এবং তাঁর জন্য অপেক্ষা করব। আমাদের জীবনধারা এমন হতে হবে যেন তিনি ফিরে এলে আমাদের তাঁর সঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করেন।

ইমাম মাহদী (আ.) বলেন:
"যদি আমার অনুসারীরা সত্যিকারভাবে আমার প্রতি অনুগত হতো, তাহলে আমি দেরি করতাম না।"
(বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৫৩, পৃষ্ঠা ১৭৭)

৪. সত্যের পথে ধৈর্য ধারণ করা:

ইমামের (আ.) অনুপস্থিতির সময় একটি কঠিন পরীক্ষা। আমাদের ধৈর্য ধরে ইসলামি মূল্যবোধ বজায় রাখতে হবে এবং ইমামের (আ.) প্রতি অবিচল থাকতে হবে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
"আমার উম্মতের মধ্যে ধৈর্যশীল কিছু ব্যক্তি থাকবে, যারা আমার আহলে বাইতের প্রতি অবিচল থাকবে, যদিও তারা অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষা ও বঞ্চনার সম্মুখীন হবে। তাদের জন্য জান্নাতে সর্বোত্তম প্রতিদান অপেক্ষা করছে।"
 (বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৫২, পৃষ্ঠা ১২৫)

৫. ইলম ও জ্ঞানের চর্চা করা:

ইমামের (আ.) একজন প্রকৃত অনুসারী হতে হলে ইসলামের জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং তা প্রচার করতে হবে।

ইমাম বাকির (আ.) বলেন:
"আমাদের শিয়া হচ্ছে তারা, যারা জ্ঞানার্জনে নিষ্ঠ থাকে, আল্লাহর জন্য কাজ করে, এবং নিজেদের চরিত্র উন্নত করে।"
 (বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৭৮, পৃষ্ঠা ৩৪৬)

আমাদের উচিত:
কুরআন ও হাদীসের জ্ঞান অর্জন করা।
ইমাম মাহদী (আ.) সম্পর্কিত বিষয়গুলো জানা।
সমাজে সত্য প্রচার করা।

উপসংহার:

ইমাম মাহদী (আ.)-এর জন্য অপেক্ষা করা কেবল একটি আবেগের বিষয় নয়; বরং এটি একটি দায়িত্ব। প্রকৃত অপেক্ষাকারী হল সেই ব্যক্তি, যে আত্মশুদ্ধি অর্জন করে, সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে এবং ইমামের (আ.) আদর্শ অনুসারে জীবনযাপন করে।

আমরা যদি সত্যিই ইমাম মাহদী (আ.)-এর অনুসারী হতে চাই, তবে আমাদের নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে, সমাজের কল্যাণে কাজ করতে হবে এবং সর্বদা ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। এই যমীনকে পুনরায় উর্বর ও প্রস্তুত করতে হবে। এই অপেক্ষা শুধু ধৈর্যের নয়, বরং সক্রিয় প্রস্তুতির অপেক্ষা।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইমামের (আ.) প্রকৃত অনুসারী হওয়ার তাওফিক দান করুন।

اللهم عجل لوليك الفرج
 হে আল্লাহ, আপনার ওলির (ইমাম মাহদী আ.) আগমন দ্রুত করুন।ইলাহী আমিন।

লেখক: কবির আলী তরফদার কুম্মি।
তারিখ:০৯/০২/২০২৫

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha